সংবিধান সংস্কারের বেশিরভাগ প্রস্তাবেই একমত এনসিপি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৮ মার্চ, ২০২৫, ০৯:৫৯ সকাল

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। বাকিগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই মূল প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত হলেও মমামত আমলে নেওয়া হলে পুরোপুরি একমত হওয়ার কথা বলেছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বাদানকারী ছাত্রদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলটি। তবে কয়েকটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছে তারা। প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রধান পদে থাকতে না পারা এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে এসসিপি। অবশ্য এ প্রস্তাব দুটির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নমত প্রকাশ করেছে বিএনপি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার আমার দেশকে বলেন, এনসিপি মনে করে জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাহাত্তরের সংবিধানের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। এ সংবিধান বাতিল অবস্থায় টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণে এনসিপির দাবি, আসন্ন নির্বাচন হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন, যার মাধ্যমে বিজয়ীরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করবে এবং দেশ পরিচালনা করবে। যেসব দল বাহাত্তরের সংবিধানকে টিকিয়ে রাখতে সংস্কারের বিরোধিতা করছে, অচিরেই গণরায় তাদের বিরুদ্ধে যাবে।

যেসব প্রস্তাবে একমত : নাগরিকতন্ত্রের ক্ষেত্রে চারটি প্রস্তাবের মধ্যে ‘বাংলাদেশি’ এবং বিদ্যমান সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) বিলুপ্তির বিষয়ে একমত এনসিপি। তবে বাংলাদেশের অধিবাসী বিভিন্ন জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে বলে মনে করে দলটি। সংবিধানের মূলনীতির ক্ষেত্রে দুটি প্রস্তাবেই একমত এনসিপি। তবে ‘বহুত্ববাদের অর্থ হবে বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহুসংস্কৃতির দেশ’Ñ এভাবে লেখার মাধ্যমে বহুত্ববাদের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করার প্রতি জোর দিয়েছে দলটি। রাষ্ট্রের মূলনীতির ক্ষেত্রে একটি প্রস্তাব রয়েছে, তাতে একমত এনসিপি। মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পাঁচটি প্রস্তাবের সবগুলোতেই একমত এনসিপি।

আইনসভার ক্ষেত্রে একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, যার একটি নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (National Assembly) এবং একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট) গঠন করা এবং উভয় কক্ষের মেয়াদ চার বছর হওয়ার ব্যাপারে একমত এনসিপি। অবশ্য বিএনপি চার বছরের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে। এনসিপি নিম্নকক্ষের প্রস্তাবিত ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০ আসন উন্মুক্ত থাকা এবং ১০০ আসনে নারী প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে একমত দলটি। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হওয়া নিয়েও সংস্কার কমিশনের সঙ্গে একমত এনসিপি। উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্যে ১০০ জন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হওয়া এবং বাকি পাঁচজন রাষ্ট্রপতির মনোনীত করার বিষয়ে একমত এনসিপি। তবে নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থী ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে দলটি। পিআর পদ্ধতির বেলায় একমত হলেও ভগ্নাংশের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের উপরে গেলে তা রাউন্ড ফিগার করার (১.৪%=১%; ১.৬%=২%) মত দিয়েছে এনসিপি। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের প্রস্তাবে একমত তারা।

সংবিধান সংশোধনী, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং অভিশংসনের একটি করে প্রস্তাব রয়েছে, তাতে একমত এনসিপি। নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে তিনটি প্রস্তাব রয়েছে, তার সবগুলোতে একমত এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ক্ষেত্রে তিনটি প্রস্তাবের সবগুলোতে একমত এনসিপি। তবে এনসিসির সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে নিয়োগ দেওয়া অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠানোর আগে এনসিসির সদস্যদের ভোট নেওয়ার কথা বলেছে দলটি।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তিনটি করে প্রস্তাব রয়েছে, যার সবগুলোতে একমত পোষণ করেছে এনসিপি। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে দ্বিতীয়টিতে একমত হলেও দলটি বলেছে, এনসিসিই নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। রাষ্ট্রপতি ও আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত এনসিসির অন্য সদস্যদের থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা যেতে পারে। এ সরকারের মেয়াদ ৭০-৭৫ দিন হওয়া যথেষ্ট।

বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ছয়টি প্রস্তাব রয়েছে, যার মধ্যে চারটিতে একমত এনসিপি। তবে এনসিসির বিরুদ্ধে প্রয়োজন মোতাবেক সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তদন্ত ও অনুসন্ধান করতে পারা এবং বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার পমামর্শ দিয়েছে দলটি। অধস্তন আদালতের দুটি প্রস্তাব রয়েছে, তাতে একমত পোষণ করেছে তারা। স্থানীয় সরকারের ছয়টি প্রস্তাবের সবগুলোতে একমত এনসিপি। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা সমন্বয় কাউন্সিলের Majority-এর ভিত্তিতে মনোনয়ন করা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির বেলায় নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে যা গণপরিষদের আইনি অনুমোদন দেওয়ার মত দিয়েছে দলটি। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস ও সাংবিধানিক কমিশনসমূহের বেলায় একটি করে প্রস্তাব রয়েছে, তাতে একমত তারা। বিবিধের দুটি প্রস্তাবের একটিতে একমত এনসিপি।

যেসব প্রস্তাবে আংশিকভাবে একমতএক্ষেত্রে এনসিপি বলেছে, তারা এসব মূল প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। তবে তাদের মমামত আমলে নেওয়া হলে তাতে পুরোপুরি একমত হবে। নাগরিকতন্ত্রের ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রভাষা’ কথাটি হবে ‘দাপ্তরিক ভাষা’, অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ। এতে বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে অপরায়নের বোধ তৈরি হবে না। মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সাধারণ সীমা নির্ধারণ ও আরোপের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার সুনির্দিষ্ট করার কথা বলেছে এনসিপি। আইনসভার ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণী বিবেচিত হওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ করা যেতে পারে, ডেপুটি স্পিকার একজন এবং বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন করা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের প্রধান নন, মন্ত্রীদের মধ্যে First among the equals হিসেবে বিবেচিত হবেন। অর্থবিলের পাশাপাশি দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ থাকা প্রয়োজন। অন্যসব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন।

নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হবেন মন্ত্রিসভার First among the equals এবং রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ Non-binding হবে। প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারবেন, যদি প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার First among the equals হন। অন্তর্বর্তী সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে অভিহিত করতে হবে।

বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বেলায় বিগত ACR (Annual confidential report) এবং লাভজনক পদে পদায়নের রিপোর্টকে বিবেচনায় নিতে হবে। দুর্নীতি, নৈতিক স্খলন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির না থাকা সাপেক্ষে উচ্চকক্ষের শুনানির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। জরুরি অবস্থার (বিবিধ) ক্ষেত্রে সংসদ চলাকালীন উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না।

যেসব প্রস্তাবে একমত নয় : নাগরিকতন্ত্রের ১. সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘Republic’ ও ‘People's Republic of Bangladesh’ শব্দগুলো বহাল রাখার ব্যাপারে একমত নয় এনসিপি। বিদ্যমান বাংলায় কোনো সমস্যা নেই বলে মত দলটির। আইনসভার ক্ষেত্রে প্রার্থিতার ন্যূনতম বয়স ২৩ এবং ভোটাধিকারের বয়স ১৬ করায় মত তাদের।

প্রধান উপদেষ্টার ক্ষেত্রে এনসিপি বলেছে, এনসিসিই যদি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পায়, তাহলে এ বিধানগুলো প্রয়োজন পড়বে না। মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির কথা বলেছে এনসিপি। লোয়ার হাউস তথা সংসদে বিদ্যমান আসনভিত্তিক পদ্ধতি এবং আপার হাউস তথা জাতীয় পরিষদে আনুপাতিক ভিত্তিতে। যেমন কোনো দল জাতীয় পর্যায়ে ৩৫ শতাংশ ভোট পেলে আপার হাউসে ৩৫টি আসন পাবে। ভোটাররা একবারই ভোট দেবে।

বাস্তবায়নের পদ্ধতির ক্ষেত্রে দলটি বলেছে, স্থানীয় সরকার অংশের ৫ ও ৬ বাদে বাকি সব বিধান হয় গণপরিষদ নির্বাচন অথবা গণপরিষদ কাম পার্লামেন্ট তথা নির্বাচিত গণপরিষদ যা সংবিধান প্রণয়ন শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনসভায় রূপ নেবেন এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে। টিকচিহ্নের ঘরে এনসিপি গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে এই ঘরে টিক দিয়েছে। তবে নির্বাচিত বডি প্রথমে গণপরিষদের দায়িত্ব শেষ করবে, তারপর আইনভায় রূপ নেবে এই পদ্ধতিকে এনসিপি অধিকতর যৌক্তিক ও নির্ভুল মনে করে।

Link copied!