রানা প্লাজা ধসের ৭তম বার্ষিকী আজ শ্রমিকরা চোখের জল ফেলবে ঘরে বসেই

প্রকাশিত : ২৪ এপ্রিল ২০২০

আজ ২৪ এপ্রিল। সাভারের রানা প্লাজা ধসের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ৭ বছর পূর্তি। দিনটির ভয়াবহতার কথা বিশ্বের মানুষ কখনোই ভুলবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। নিমেষেই একটি ভবন ভেঙে জীবনের সবচেয়ে বড় দাম দেয় এক হাজার ১৪২ জন শ্রমিক-কর্মচারী। তাদের জীবনের বিনিময়ে টেকসই শিল্পের পথে পোশাক খাত। আজ এক ভিন্নরকম পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা যার যার ঘরে বসে চোখের জলেই পালন করবে এই দিন।

করোনা ভাইরাস মহামারীতে দেশের অধিকাংশ পোশাক শ্রমিক কারখানা বন্ধ রয়েছে। কোথাও কোনো সভা-সমাবেশও করার অনুমতি নেই। ফলে শ্রমিক সংগঠনগুলো বিবৃতির মাধ্যমেই মূলত পালন করবে এদিন।বাংলাদেশের ইতিহাসের এই নৃশংস মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার মোটেও এগোয়নি। মামলার দুজন অভিযোগপত্রভুক্ত আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় বর্তমানে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ছিল বুধবার।

প্রতিদিনের মতোই শ্রমিকরা গিয়েছিলেন রানা প্লাজায় থাকায় ৫টি পোশাক কারখানায়। তবে অভিযোগ রয়েছে, ভবনে ফাটল থাকায় শ্রমিকরা ঐদিন কারখানায় কাজ করতে চাননি। কিন্তু মালিকপক্ষ অনেকটা জোর করেই শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। সবে কাজে মনোযোগ দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। তখনই বিকট শব্দে ৯ তলা ভবন ধসে যায়। এই ঘটনায় প্রাণ হারান এক হাজার ১৪২ জন শ্রমিক-কর্মচারী। আহত হন কয়েক হাজার শ্রমিক। এদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছেন। অনেকেই মৃত্যুক‚প থেকে ফিরে এসে মানসিকভাবে হারিয়েছেন ভারসাম্য।

সাভারের রানা প্লাজা ধসের সেই মর্মান্তিক এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশে গোটা পোশাক খাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা চাপের মুখে পড়ে যান। এটির ধারাবাহিকতায় ইউরোপের ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড’ ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট ‘অ্যালায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা হয়। যা মূলত বাংলাদেশে পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন, সুপারিশ ও তদারকি করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫ বছরের জন্য জোট দুটি প্রতিষ্ঠা হয়।

পাঁচ বছরে জোটভুক্ত কারখানাগুলোর সংস্কার অগ্রগতি ৯০ শতাংশের উপরে। তবে এ দুটি জোটভুক্ত ক্রেতাদের কাছে পোশাক রফতানি হয় না, এমন দেড় হাজার কারখানা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের শুরুতে উদ্যোগ নেয় সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়। এছাড়া পোশাক খাতের নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘গ্রিন কারখানা’। সারাবিশ্বে বাংলাদেশেই এত বেশি কারখানা গ্রিন কারখানা হিসেবে সনদ পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) কর্তৃক বাংলাদেশের ৬৭টি কারখানা অর্জন করেছেন ‘দ্য লিডারশিপ এনার্জি এনভায়রনমেন্ট ডিজাইন’ (এলইইডি) সনদ।

যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মাত্র ৫টি কারখানা এই সনদ অর্জন করতে পেরেছে। শিগগিরই বাংলাদেশের আরো ২৮০টি পোশাক কারখানা ‘দ্য লিডারশিপ এনার্জি এনভায়রনমেন্ট ডিজাইন’ (এলইইডি) সনদ পেতে যাচ্ছেন বলে বিজিএমই সূত্রে জানা গেছে। এটি টেকসই পোশাক খাতের জন্য বড় অর্জন। তবে সাম্প্রতিক মহামারীতে আর সবকিছুর মতো থমকে গেছে পোশাক শিল্পও। যদিও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, পরিস্থিতির উন্নতি হলে পোশাক রফতানি আয়ে বড় উল্লম্ফন হবে। তবে যে শ্রমিকদের জীবনের বিনিময়ে পোশাক খাতের এই এগিয়ে চলা সেই শ্রমিকদের পরিবার এখনো বিচারের দেখা পায়নি।

থমকে আছে এটির বিচার কার্যক্রম। কবে নাগাদ মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানাতে পারেননি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) খোন্দকার আবদুল মান্নান। গতকাল তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার হত্যা মামলায় দুজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বহাল থাকার কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ রয়েছে। আমরা আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যে ওই দুই আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হবে এবং মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে।

পিপি আবদুল মান্নান জানান, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাদের (পিপি) পক্ষে কিছু করার থাকে না। বরং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেবেন। দুজন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকায় রানা প্লাজা ধসের হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ থাকার বিষয়টি জানানোর পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সুপ্রিম কোর্ট খোলার পরপরই রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যার মামলায় দুই আসামির পক্ষে থাকা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন।

সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এ পর্যন্ত ১৩শ’টি কারখানা বন্ধ হয়েছে তবে নতুন করে তৈরি হয়েছে ৭২৩টি ফ্যাক্টরি। এছাড়া শ্রম আইন সংশোধন, কল-কারখানা পরিদর্শন পরিদফতরকে শক্তিশালী করতে অধিদফতরে রূপ দেয়া, পরিদর্শক সংখ্যা বাড়ানো, তিন দফা মজুরি বাড়ানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এই রানা প্লাজা ধস ইস্যুতেই যুক্ত বাংলাদেশের রফতানিতে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছিল। যা এখন পর্যন্ত ফিরে পাওয়া যায়নি।

আপনার মতামত লিখুন :