বঙ্গোপসাগরে অবৈধ ট্রলিংয়ে ধ্বংস হচ্ছে মাছের আবাসস্থল
প্রকাশিত : ১৩ মার্চ ২০২৫

কলাপাড়া প্রতিনিধি: পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে দিন দিন বাড়ছে মাছ শিকারের অনুমোদনবিহীন অবৈধ নৌযান ট্রলিং বোট। এসব ট্রলারে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে অবাধে শিকার করা হচ্ছে সব ধরনের মাছ। এতে মারা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। ফলে মাছ শূন্য হয়ে পড়েছে সমুদ্র। বিগত কয়েকবছর ভরা মৌসুমেও আশানুরূপ ইলিশ না পেয়ে দিশেহারা মৎস্য ব্যবসায়ীরা। ফলে ঋণের দায়ে অনেকেই ছেড়েছেন পেশা। অপরদিকে বেড়েছে জলদস্যুর উৎপাত ইতোমধ্যে কয়েকটি ট্রলারে ডাকাতি চালিয়ে লুট করে নিয়েছে মাছ, জ্বালানী তৈলসহ কয়েক লক্ষাধিক টাকা। এতে আতঙ্কিত রয়েছে জেলেরা।
গবেষকরা বলেন, গভীর সমুদ্রে ট্রলিং বোট দিয়ে মাছ শিকার করায় ধ্বংস হচ্ছে মাছের আবাসস্থল। এতে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের সকল মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা। অনুমোদনহীন এসব নৌযান ট্রলিং বোটের মাধ্যমে মাছ শিকার করায় কমে যাচ্ছে উৎপাদন। মৎস্যজীবীরা বলেন, ট্রলিং বোটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে না পারলে আগামী দু’এক বছরের মধ্যেই মাছ শূন্য হয়ে পড়বে বঙ্গোপসাগর।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুর ঘুরে দেখা যায়, সমুদ্রে মাছ শিকার শেষে খাপড়াভাঙ্গা নদীর দু’পাশে নোঙ্গর করে আছে কয়েক’শ নিষিদ্ধ ট্রলিং। এসব অবৈধ নৌযানে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে সমুদ্রে মাছ শিকার করা হয়। প্রতিটি বোটেই রয়েছে নিষিদ্ধ জালে ভরা।
মৎস্য আড়ৎদারদের অভিযোগ রয়েছে , এসব ট্রলিং বোটের মাধ্যমে নির্বিচারে মাছ শিকার করায় সমুদ্রে মাছের অকাল দেখা দিয়েছে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মৎস্য আহরণে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মাছ শূন্য হয়ে পড়বে সমুদ্র।
ট্রলিং বোট ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম হলেও ক্ষতি হচ্ছে অনেক বেশী। মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুর বহিরাগত সহ ট্রলিং ব্যবসায়ীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক।
অপরদিকে এ অঞ্চলে লম্বাজাল, খুটাজাল, ছান্দিজালের মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে কয়েক হাজার। আর এই সমস্ত ট্রলারের হাজার হাজার জেলে পরিবারের ভরণ পোষণের একমাত্র মাধ্যম সমুদ্রে মাছ শিকার করা।
বঙ্গোপসাগরে ট্রলিং বোট দিয়ে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করায় সব প্রজাতির মাছের পোনা মারা যাওয়ায় মাছ শুন্য সাগরে বৈধ প্রক্রিয়ায় মাছ শিকারে যাওয়া জেলেরা মাছ না পেয়ে এখন দিশেহারা।
হাজার হাজার সাধারণ জেলে কর্মহীন হয়ে বর্তমানে ঋণগ্রস্থ হয়ে পরেছে। এমতাবস্থায় অনেকেই ভাবছেন পেশা পরিবর্তনের কথা। এসব জেলেদের রয়েছে অনেক কষ্ট, বেঁচে থাকার আকুতি। একদিকে যেমন মাছ না পেয়ে জেলেরা হতাশাগ্রস্থ, অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে রূপালী ইলিশ না থাকায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই বঙ্গোপসাগরে ট্রলিং বোট দিয়ে মাছ শিকার করায় সরকারের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। নিষিদ্ধ ট্রলিং বোট নিয়ে বিপাকে পড়ছে মৎস্য বিভাগও। মালিকরা ট্রলিং বোট চলাচলের বিষয়ে আদালতে রিট আবেদন দাখিল করায় কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারছে না মৎস্য বিভাগ। সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়ানো ট্রলিং বোটগুলোর মধ্যে আলীপুর-মহিপুরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি এবং বহিরাগত বোট রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫টি, এছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলা পাথরঘাটা-বরগুনায় রয়েছে ৫৫ থেকে ৬৫টিসহ সারা দেশে শত শত অনুমোদনহীন নৌযান ট্রলিং বোট রয়েছে।
মহিপুর এলাকার জেলে খবির ঘরামী বলেন, ট্রলিং বোটের ভীড়ে আমরা সমুদ্রে জায়গা পাইনা। তারা বিভিন্ন সময় আমাদের জাল পাল্লা ছিড়ে ফেলে। এ সকল ট্রলিং বন্ধ করতে না পারলে সমুদ্র মাছ শূন্য হয়ে পড়বে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের আবেদন ট্টলিংগুলো বন্ধ করা হোক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলীপুর বন্দরের একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, ‘ট্রলিং বোট দিয়ে নির্বিচারে মাছ ধরায় এখন সমুদ্রে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যান্ত্রিক এ পদ্ধতির মাধ্যমে সব প্রজাতির এবং সব আকৃতির মাছ ধরা হচ্ছে। ছোট মাছ মেরে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হচ্ছে। ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, এর ফলে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করণে সরকারের নিষেধাজ্ঞাগুলো কোনো কাজে আসছে না।
এ বিষয়ে মহিপুর থানা মৎস্যজীবি দলের সভাপতি মোঃ আফজাল মোল্লা বলেন, ‘ট্রলিং বোট দিয়ে সাগরে মাছ শিকার করায় সমুদ্রে মাছের অকাল দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এই ট্রলারের অযাচিত ব্যবহার মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করছে। এর ফলে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। মাছের উৎপাদন ও আহরণ স্বাভাবিক রাখতে ট্রলিংগুলো (বোট) দ্রুত বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন, ট্রলিংয়ে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় বোট মালিকদের নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু তাহারা সমুদ্রে মাছ শিকার করার আবেদন জানিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন। এ কারণে আমরা ট্রলিং বন্ধের জন্য কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তারপরও আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সচেতনতার জন্য মাইকিং করেছি, বিভিন্ন সভা সেমিনার করেছি। আশাকরছি খুব শীঘ্রই রিট আবেদন নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। তারপর আমরা পুরোদমে ট্রলিং বন্ধের জন্য অভিযান শুরু করবো।