ঈর্ষার অগ্নিতে জাতির আত্মদহন

প্রকাশিত : ৪ মার্চ ২০২৫

খেয়াল করেছেন, জাতিগতভাবেই আমরা কারো উন্নতি সহ্য করতে পারি না। অথচ কারো অবনতি কিংবা পতনের খবর শুনলে উল্লাস করি। এই জীবনে আমার কিছু হোক বা না হোক- বন্ধুর ভালো চাকুরি হয়েছে, পরিচিত কেউ উন্নতি করেছে কিংবা কারো কিছু টাকা পয়সা হয়েছে- শুনলেই মুষড়ে পড়ি! অথচ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারো শাস্তি হয়েছে কিংবা কারো চাকুরি চলে গেছে, বেতন বন্ধ আছে শুনলে সুখ সুখ অনুভব করি। অন্যের ভালো খবর শুনলে যতই প্রশংসা করি, মুখে হাসি রেখে বাহবা বলি কিন্তু মনে মনে ভেঙ্গে পড়ি! অথচ কারো মন্দ খবর শুনলে মুখোশে ব্যথিত হওয়ার ভান করি কিন্তু মনে মনে খুশি হই ঠিকই। এসব কারো একার সমস্যা না। জাতির জাতীয় সমস্যা ও সংকট।

কারো সুন্দরী নারী কারো দামি গাড়ি কিংবা কারো সুন্দর বাড়ি- এসব দেখলেই হিংসা আরম্ভ করি। গোপন গালিতে বলি- ও শালায় পাইলো কেমনে? অপরিচিতের অনেককিছু নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নাই কিন্তু পরিচিত-বন্ধুজনের কিছু হলেই, কিছু পেলেই গোপনে আমাদের মন খারাপ হতে শুরু করে। কারো প্রমোশনের খবর শুনলে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে, কারো ভালো অবস্থানে কথা শুনলো হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরি! মনে মনে চাই, সবার চেয়ে আমার বেশি কিছু হোক। কেউ না খেয়ে আছে, জীবন চালাতে পারছে না কিংবা অন্যের কাছে হাত পাতছে- এমন দৃশ্য কল্পনা করতেও আমাদের মন ভালো হয়ে যায়! কারো নাজেহাল অবস্থা নিয়ে আমাদের যে ভাবনা তা প্রকাশ্যে এলে অন্যান্য জন্তুদের আমাদের জন্য ঘৃণা আসতো! অথচ পাশবিকতা মনের অনেকটা জুড়েই পুষি।

বাঙালির দোয়া কেমন? খোদা, আমার একটি চোখ অন্ধ করে দাও, বাকিদের যাতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পড়শীর ছেলের চাকুরি যাতে আটকায় সেজন্য নিজের গোয়ালের গরু বিক্রি করে থানায় টাকা দেওয়ার নজির বাংলার গ্রামে গ্রামে আছে! প্রতিবেশীর মেয়ে বিয়ে ভাঙতে গাড়ি ভাড়া করে পাত্রপক্ষের কাছে দুর্নাম বলে আসি। কারো অনুপস্থিতি তার নামে যে-সব কথা বলি, যে সকল বিষয়ের আলোচনা তুলি তা দিয়েই আমাদের মানসিকতা মাপকে পারি। আমরা ভালো! তবে অনেকেই ভালোর অধিক খারাপ। জাতি হিসেবে আমাদের অনেকগুলো গুণ আছে। গর্ব করার মতো অনেকগুলো গৌরবও আছে। তবে ঘৃণিত হওয়ার মত দোষও আছে।

আমরা ঈর্ষাকাতরতার তীব্র অসুখেও আক্রান্ত। আমরা পরের ভালো, কারো মঙ্গল সহ্য করতে পারি খুব কম। এমনকি আপন সহোদর-সহোদরা থেকে, সহকর্মী কিংবা বন্ধুবান্ধবদের মধ্য থেকে কেউ উন্নতি করলে বাইরে বাইরে খুশি দেখানোর চেয়েও মনে মনে মন খারাপ করি বেহিসাব! আমার চেয়ে কেউ উপরে উঠুক, কেউ সুনাম কুড়াক- জাতিগতভাবেই এটা সহ্য করতে পারি না। এখানে আসলে খারাপের বিষ খারাপ দিয়ে কাটাকাটি হয়! সমাজের চাপে মুখে হাসি রাখি নয়তো আমাদের মনের মধ্যে যা তাতে আমাদের মানসিকভাবে অসুস্থ বলার কথা! তবে সুবিধা আছে, এখানে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ কিন্তু কেউ দেখায় না, ধরা দেয় না! তবে সবাই সবটা জানে।

জাতির এমন জাতীয় ব্যাধির চিকিৎসা কী? উত্তরণ কি আদৌ নাই? আছে। নিজেই নিজের উন্নতির চেষ্টা করা। অন্যের সাথে নিজের তুল্য না করা। হিংসা ও ঘৃণা থেকে বেঁচে থাকা। এসব বলা যতখানি সহজ বাস্তবে পরিণত করা ততখানি কঠিন। তবে উপায়? ভালো মানুষের সংস্পর্শে থাকার। উদার মানসিকতার মানুষের কাছ থেকে শেখা। ভালো বই পড়া, ভালো ভালো সিনেমা দেখা। যে ব্যাধি রক্তের সাথে মিশে আছে তা চাইলেও একদিনে বিদায় করা যাবে না। এজন্য ধর্মের কাছে ফিরতে হবে। একটু একটু করে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা ও চিন্তা করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্যই নিজেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত মানুষে পরিণত করা। অল্প অল্প পরিবর্তনে মানুষ একদিন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে- প্রত্যাশা। পরিবর্তন আমার ও আপনার- উভয়ের মাঝেই আসুক।

রাজু আহমেদ

raju69alive@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :