আগামীকাল ১৪ ডিসেম্বর, বরগুনার আমতলী মুক্ত দিবস

প্রকাশিত : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১

মাইনুল ইসলাম রাজু, আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি: আগামীকাল (১৪ ডিসেম্বর) বরগুনার আমতলী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ডিসেম্বর সকালের দিকে জয়বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে কয়েক হাজার লোক আমতলী থানায় উপস্থিত হয়ে তৎকালীন পুলিশের সিআই সেকান্দার আলী ও ওসি রইস উদ্দিন ভূইয়াসহ তাদের সাঙ্গ- পাঙ্গদের আটক করেন। আমতলী থানাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষনা করা হয়। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম পাশা তালুকদারকে অন্তর্র্বতীকালীন আমতলী থানার (ওসি) নিযুক্ত করে। আটক হওয়া ওসিসহ বাকীদের মুক্তিযোদ্ধারা সাথে করে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গলাচিপা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে ওই থানায় ওসি রইস ভূইয়ার অনেক কুর্কীতি থাকায় সেখানেই তাকে মেরে ফেলা হয়।

৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর ১৫ মার্চ গঠন হয় স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন বরিশাল বজ্রমোহন কলেজের ভিপি সাবেক ভিপি অ্যাড. নাসির উদ্দিন তালুকদার। ওই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হওয়ার পর ২৩ মার্চ সারাদেশে মতো আমতলীতেও পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। আর তৎকালীন ঢাকাস্থ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ হেড কোয়ার্টারের অফিস ভবনে আমতলীর কৃতি সন্তান হাবিলদার শহীদ এম.এ বারেক খান উড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশের পতাকা।

সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে আমতলী বন্দরের (বর্তমান পৌর শহরেরর ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড) চারদিকে পরিখা খনন করে সুরক্ষিত করা হলো। আমতলীতে সর্বস্তরের সক্ষম পুরুষদের সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্যে এক সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। প্রশিক্ষণ পরিচালনায় ছিলেন আমতলী থানার পুলিশ সদস্য (বকসী) আঃ বারেক ও এমইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বজলুর রহমান (বি. রহমান)।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক হানাদার বাহিনী আমতলী থানা দখল করলো। যুদ্ধকালীন পুরোটা সময়ে আমতলী বন্দর (শহর) ব্যাতীত পুরো গ্রামাঞ্চল ছিল মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ওই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেজর নাদের পারভেজ বেশ কয়েকবার গান বোট নিয়ে আমতলী থানায় আসে। পরবর্তীতে তার নির্দেশে ওসি রইস উদ্দিন বন্দরের আসে পাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপরে বেশ কয়েকবার হামলার চেষ্টা চালায় কিন্তু প্রত্যেক বারই তিনি ব্যর্থ হন।

এলো ১৪ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনীরা সিদ্ধান্ত নেয় আমতলী থানা দখলে নেওয়ার। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম আছমত আলী আকন নৌকাযোগে আমতলী বন্দরে আসেন। আমতলীর বীরমুক্তিযোদ্ধা আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস এলেন দলবল নিয়ে। গলাচিপার সন্তান কমান্ডার আঃ রব এলেন তার দল নিয়ে। আমতলী থানার ওসি রইস উদ্দিন ভূইয়ার সাথে চুক্তি হয় বিনা রক্তপাতে আমতলী থানার পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করবে। কমান্ডার আঃ রব তার বাহিনী নিয়ে অবস্থান নেয় থানার পূর্ব পাশে নদীর ওপাড়ে একে স্কুলের পুকুর পাড়ে। কথা ছিল মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে পুলিশ, রাজাকারসহ সবাই আত্মসমর্পণ করবে এবং তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র নৌকাযোগে নদীর অপর পাড়ে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু সিআই (সার্কেল ইনসপেক্টর) সেকান্দার আলীর নির্দেশে পুলিশ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। এ সিদ্ধান্ত মুক্তিবাহিনীর অজানা ছিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোররাতে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা তাদের রাইফেল দিয়ে একটি ফাঁকা আওয়াজ করলে ওসি রইস উদ্দিন ভূইয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গসহ পাল্টা গুলি চালায়। তখন মুক্তিবাহিনীরা বুঝলো ওসি রইস উদ্দিন ভূইয়া তাদের সাথে চুক্তির বরখেলাপ করেছে। তখন দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলল ভোর পর্যন্ত। ওই গোলাগুলিতে অজ্ঞাত এক নৌকার মাঝি শহীদ হয়ে ছিলেন। সে সময় পিরোজপুরের ফেরদৌস হায়দার নামে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটা কলাগাছকে সম্বল করে হাতে তরতাজা গ্রেনেড নিয়ে থানার দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে নদীর এপাড়ে এসে সেটি থানার সামনে চার্জ করেন। এতে ভয় পেয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা।

ওদিকে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় জনতাকে একত্রিত করে জয়বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললো চারদিক থেকে। পরিস্থিতি ঘুরে গেল। পুলিশ ভাবলো মুক্তি বাহিনীর সংখ্যা কয়েক হাজার। ভয় পেয়ে গেল হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দালালরা, আত্মসমর্পণ করলো। মুক্তিযোদ্ধা আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং উপস্থিত জনতা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আমতলী থানাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে।

আমতলী মুক্ত দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসটি পালন উপলক্ষে আমতলী উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, পৌরসভা, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ নানা কর্মসূচিতে পালন করবে বলে জানিয়েছে।

আপনার মতামত লিখুন :