পালিত হয়নি রোহিঙ্গা আগমনের ৪র্থ বর্ষপূর্তি

প্রকাশিত : ২৫ আগস্ট ২০২১

২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। অনেকটা নীরবেই ৪র্থ বর্ষপূর্তি পালন করেছে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের ঢল নেমেছিল। পরবর্তী ওই বছর প্রায় একমাসে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৭৮৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আগমন করে। নিজ দেশের প্রচুর সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক বিবেচনায় বাস্তুচ্যুত এসব রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সীমান্ত খুলে দিয়ে নজিরবিহীন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত মানুষ নিজ জন্মভূমিতে ছেড়ে অন্য দেশে পালিয়ে আসার ঘটনা বিরল। সেই দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে উখিয়া-টেকনাফ এলাকার হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ, সুশীল সমাজ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা তাদের যা ছিল, আবাসন, খাদ্য, কাপড় ভাগাভাগি করে রোহিঙ্গাদের সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন।

এছাড়াও এলাকার বননির্ভরশীল সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী দরিদ্র লোকজন তাদের বিনিয়োগের বাগান ছেড়ে নির্যাতিত মানুষগুলোকে জায়গা করে দেন। এর প্রায় দু’মাস পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এসব শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারের কাছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৯ জন রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এদের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার ৭০৪ জনকে ফেরত নেওয়ার জন্য ছাড়পত্র দেন। কিন্তু এ ছাড়পত্রের দীর্ঘ আড়াই বছর অতিবাহিত হচ্ছে, এপর্যন্ত একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীও মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি। পর পর ২ বার মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য দিনক্ষণ ঠিক হলেও মিয়ানমার সরকারের অনীহায় ২টি প্রত্যাবাসন উদ্যোগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়। গত একবছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আর কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। কুটনৈতিক মহলেও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে দিনদিন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।

আরআরআরসি অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরুনতলী এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধ ২টি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র গত তিন বছর আগে নির্মাণ করা হয়। এই ২টি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র ছাড়াও বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে আরও ২টি নতুন প্রত্যাবাসন কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এরআগে নির্মিগ প্রত্যাবাসন কেন্দ্র ২টিকে করোনাকালীন রোহিঙ্গাদের জন্য কোয়ারান্টাইন সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে এদেশে রোহিঙ্গা আগমনের মতই আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপে কিছু দিনের মধ্যে তারা নিজ দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে ধীরে ধীরে স্থানীয় জনগণের ধারণা পাল্টাতে শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গা আগমনের কয়েক বছর পর্যন্ত তাদের মায়ানমারে ফেরত নেয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা এবং মায়ানমারের সরকারের উপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেলেও বিগত দু’বছর এর কোন কর্মতৎপরতা খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারা যতটা না মানবিক মর্যাদা নিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তৎপর, তার চেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাদের ক্যাম্পে অন্যান্য সহযোগিতা করা।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসা শুরু হওয়ার পর পার্সপোট অধিদপ্তর ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেজিষ্ট্রেশন কার্যক্রমে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী দ্বৈত সুবিধা নেওয়ার জন্য দ্বৈত রেজিষ্ট্রেশন করেছিলে। রেজিষ্ট্রার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা বর্তমানপ ১১লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। পরে সার্ভার যুক্ত করে রেজিষ্ট্রেশনকৃত রোহিঙ্গার সংখ্যা কমে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৭৮৭ জনে দাঁড়ায়। যেখানে পরিবারের সংখ্যা হয়েছে এক লক্ষ ৭৯ হাজার ৫৯০ টি। গত চার বছরে ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া শিশু, পরে মায়ানমার থেকে বিভিন্নসময়ে বিচ্ছিন্নভাবে আসা রোহিঙ্গা, পুরাতন রোহিঙ্গা সহ বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালের আগে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের শরণার্থী মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত ২০১৭ সালের আগস্ট হতে আগত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হয়নি।

এদিকে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফর ৩৪ টি ক্যাম্পে অবস্থান করা এসব রোহিঙ্গারা তাদের আগমনের চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি বলে জানা গেছে। তারা বর্ষপূর্তি উদযাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতিও চাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সুত্র জানিয়েছে, ক্যাম্পে কর্মরত আইএনজিও এবং এনজিও সমুহের সম্মিলিত সংগঠন আইএসসিজি এর পক্ষ থেকে ক্যাম্পে চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন না করার জন্য ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

গত ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে রোহিঙ্গারা বিশাল সমাবেশ করে। এতে প্রশাসন এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিঁতিতে পড়ে যান। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক থ্রীজি’র নীচে থাকা সহ আরো বিভিন্ন কারণে এবার তারা কোন বর্ষপূর্তি উদযাপন করেনি।

আরআরআরসি অফিসের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৩০ হাজার ৪০০ জন শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে জন্ম লাভ করে। তবে আগমনের প্রথম বছর এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি। সে হিসাবে গত ৪ বছরে প্রায় দেড় লাখ শিশু ক্যাম্প সমুহে জন্ম নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এতিম রয়েছে, ৩৯ হাজার ৮৪১ জন। এরমধ্যে ১৯ হাজার ৫৯ জন ছেলে ও ৮২ হাজার ৮৮২ জন মেয়ে। আবার ৮ হাজার ৩৯১ জনের মাতা-পিতা কেউ নেই।

আরআরআরসি অফিসের প্রদত্ত পরিসংখ্যান মতে, বছরে গড়ে গর্ভবতী হয় হয়-৩৫ হাজার ৪ জন মহিলা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উখিয়া টেকনাফের ভূমি ব্যবহার করা হয়েছে ৬ হাজার ৫ শ’ একর। ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ২৮ টি ক্যাম্পে UNHCR এর আর্থিক সহায়তায় ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে।

ক্যাম্প গুলোতে গত ৪ বছরে নলকূপ বসানো হয়েছে ৮ হাজার ৯ শ’ ২৫ টি, টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে ৫ হাজার ৭শ’ ৩৬ টি, অস্থায়ী ও মধ্য মেয়াদী শেল্টার হোম নির্মাণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ১২ হাজার ৬০৭ টি, গোসলখানা নির্মাণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫২২ টি, ক্যাম্প গুলোতে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ৩৪’৬০ কিঃমিঃ। ক্যাম্প এরিয়ার অভ্যন্তরে খাল খনন করা হয়েছে ৩০ কিঃমিঃ, বন্য হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জন রোহিঙ্গার। ক্যাম্প এলাকায় বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪ হাজার ৩০০ টি। এক লক্ষ ৯২ হাজার ৫৪৭ পরিবারকে জ্বালানি হিসাবে এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গারা মাদক, নর হত্যা, অপহরণ, স্বর্ণ চোরাচালান, ডাকাতি, দখলবাজীসহ বিভিন্ন অপরাধকর্মে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। প্রতিদিন ইয়াবা সহ রোহিঙ্গারা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে ইয়াবার কারবার এখন অনেকটা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধ কর্মের কারণে উখিয়া-টেকনাফ সহ পুরো কক্সবাজারে আইনশৃংখলা পরিস্থতির অবনতি হচ্ছে।

আপনার মতামত লিখুন :