কাজিনদের বিয়ে করা কতটা নিরাপদ?

প্রকাশিত : ২৫ মার্চ ২০২১

কাজিনদের মধ্যে প্রায়ই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ক্রমে তা চূড়ান্ত পরিণতির দিকেও আগায়। কাজিনদের মধ্যে বিয়ে বলতে গেলে খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় আমাদের দেশে। এছাড়া দেশের বাইরেও রানী ভিক্টোরিয়া, চার্লস ডারউইন, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো ব্যক্তিরা নিজেদের কাজিনদের বিয়ে করেছেন। বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন জনগোষ্ঠীতে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহের প্রচলন রয়েছে, যেখানে প্রায় প্রতি তিনটি বিয়ের একটি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে হয়ে থাকে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ইরান ও দক্ষিণ এশিয়ায় নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটে। এসব বিয়ে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই বেশি হয়, তাতে আবার বাল্যবিবাহের আধিক্য।

শহর এলাকায় ছেলে-মেয়েদের একত্রে মেলামেশার কিছু সুযোগ থাকলেও গ্রামাঞ্চলে সে সুযোগ নেহায়েত নেই বললেই চলে। সেজন্যেই গ্রামে যারা থাকেন তাদের অনেকের জীবনেই প্রথম প্রেম হয়ে আসে নিজের কোনো চাচাতো মামাতো কিংবা খালাতো ভাই-বোন। স্বাভাবিকভাবেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমাদের অনেকের আকর্ষণের শুরু হয় এসব জায়গা থেকেই। কিন্তু কাজিনদের বিয়ে করা কতটা নিরাপদ? বিভিন্ন গবেষণায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে কাজিনদের মধ্যে বিয়ের ফলে যে বাচ্চা হয় তার কিছু ত্রুটি থাকে। মৌলিক জেনেটিক নীতিগুলো বোঝা গেলে এ ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

আগেই যেহেতু বলেছি, রানী ভিক্টোরিয়া, চার্লস ডারউইন, আলবার্ট আইনস্টাইন এরা সকলেই তাদের কাজিনের সাথে বিবাহে জড়িয়েছিলেন। হয়তো আপনাদের মনে হতে পারে এদের মতো লোকে যদি এ কাজ করতে পারেন তবে আমরা করলে কী সমস্যা? আমাদের দেশে কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো লোকেরা আশেপাশেই বিয়ে করতে চায়। বেশি দূরে তারা যেতে আগ্রহী না। কিন্তু আমেরিকার ২৪টি স্টেটে ফার্স্ট কাজিন অর্থাৎ সরাসরি চাচাতো ভাই-বোনকে বিয়ে করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ হিসেবে অনাগত শিশুর সম্ভাব্য জন্মগত ত্রুটিকেই দেখা হয়।

কাজিন দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম পর্যায়ের বা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ মানে আপন চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে। আর দ্বিতীয় বা সেকেন্ড ডিগ্রি রিলেটিভ মানে বাবা বা মায়ের চাচাতো, মামাতো, খালাতো বা ফুফাতো ভাইবোনের সন্তানদের মধ্যে বিয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্য রক্ত সম্পর্কের বিবাহকে বেশি উৎসাহ দিতে রাজি নয়। বলা হয় ফার্স্ট কাজিনদের (সরাসরি খালাতো, মামাতো, চাচাতো বা ফুফাতো ভাইবোন) জিনগত মিল প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ, অর্থাৎ তারা বংশপরম্পরায় অনেক জিন একইভাবে বহন করে চলেছেন। এ কারণে যেসব রোগবালাই তাদের বংশে রয়েছে, সেসব তাদের সন্তানদের মধ্যে আরো প্রকটভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিশেষ করে অটোসোমাল রিসেসিভ কিছু রোগ (যেমন, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস) পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তীব্রতর হয়ে দেখা দিতে পারে। নিজ বংশ এবং নিজ গোত্রে বিবাহরীতির কারণে থ্যালাসেমিয়া ও জিনগত রক্তরোগ মধ্যপ্রাচ্যে একসময় এত প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, আরব সরকার বিয়ের আগে বর-কনের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেয়। এ ছাড়া গবেষণা বলছে পরস্পরের আত্মীয় স্বামী-স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে জন্মগত জটিলতা, ডাউনস সিনড্রোম, গর্ভপাত বা নবজাতক মৃত্যুর হার অন্যদের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি।

নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের কারণে সন্তানের যেসব ঝুঁকি বাড়ে তা হলো:
১. গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব।
২. শারীরিক ত্রুটিসংবলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হয়।
৩. প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু।
৪. হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃত্যু।
৫. যথাযথভাবে শিশুর বৃদ্ধি না হওয়া।
৬. শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা।
৭. মৃগী রোগ।
৮. অজানা রোগ।
৯. নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সিকেল সেল ডিজিজ ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।

বাংলাদেশে এমনিতেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বেশি, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজের বাহকও কম নয়। নিকটাত্মীয়ের বিয়েতে এ ধরনের রোগ নিয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।

অর্থাৎ এমন কাজিনের মধ্যে বিবাহের ফলে প্রতি চারটি সন্তানের মধ্যে একটি সন্তানের শারিরীক সমস্যা হতে পারে। শুধু যে কাজিনের সাথে বিবাহ করলে এমন হবে তা না। বরং একই এলাকায় বা একই পরিবেশে যারা থাকেন তাদের জিনগত সমস্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই যত পারা যায় দূরে গিয়ে বিয়ে করা উচিত। এতে সমস্যার আশঙ্কা কম।

২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বধিরতা, দৃষ্টি ক্ষমতার ত্রুটি, মানসিক বিকারগ্রস্ততার মতো সমস্যাও বিবাহিত কাজিনদের সন্তানের মাঝে প্রকট। এক্ষেত্রে ব্রিটেনে জন্মত্রুটি নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের ওপর করা এক গবেষণা উল্লেখযোগ্য। দেখা গেছে, ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে ৬.১ শতাংশ শিশুর পিতামাতা কাজিন। আরো চমকপ্রদ তথ্য হলো, এই ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের ৯৮ শতাংশই হচ্ছে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। ব্রিটেনের পাকিস্তানি অভিবাসীদের মধ্যে নিজেদের মধ্যে বিবাহপ্রথা চলে আসছে লম্বা সময় ধরে।

নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানা মতবাদ প্রচলিত। কেউ মনে করেন একই পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা আত্মীয় দুটি ছেলেমেয়ের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো হবে এবং মানিয়ে নেওয়াটাও সহজ হবে। অনেক পরিবারে বা গোত্রে মনে করা হয় এতে করে পরিবারের সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবারের মধ্যেই থাকবে।

তবে শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবারের মধ্যে বিয়ে ঠিক করার আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটি, কম বয়সে দৃষ্টি ও শ্রবণ সমস্যা, জিনগত রক্তরোগ, খিঁচুনি ইত্যাদি রোগের প্রকোপ আছে কি না দেখে নেওয়া উচিত। অনেক দেশে কাজিন ম্যারেজের আগে বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিং ও স্ক্রিনিংয়েরও ব্যবস্থা আছে।

আপনার মতামত লিখুন :