বোরখা পরে মেয়েরা ক্রিকেট খেলবে: তসলিমা নাসরিন
প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
বোরখা বা খিমার পরা একটি মেয়ে তার মাদ্রাসায় পড়া পুত্রের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে, এই ছবি পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হওয়ার পর মানুষ নানারকম মন্তব্য করছে। মন্তব্যগুলো মূলত এরকম :
১। মেয়েদের খেলাধুলা করা ইসলামে হারাম। এই মেয়ে ইসলামবিরোধী কাজ করেছে। এই মেয়ে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।২। বোরখা পরে মেয়েরা সব রকমের কাজ করতে পারে, এমনকি ক্রিকেট খেলতেও পারে। বোরখা কোনও কাজের জন্য বাধা নয়।
৩। নিজের আশা আকাক্সক্ষা বিসর্জন দিয়ে ইসলামের নির্দেশে অন্দরমহলে বন্দী থাকতে হয় মেয়েদের। এই অবস্থায় একটি মেয়ে যদি বাইরে বের হয়ে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নিয়ে খেলে, তাহলে এই উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানানো উচিত।
৪। যারা খেলার ফটো তুলে পত্রিকায় ছাপিয়েছে এবং মেয়েটি যে অন্যের চাপে নয়, নিজের ইচ্ছেয় বোরখা পরেছে- তা প্রকাশ করেছে, তারা বোঝাতে চাইছে বোরখা পরা মানে অনাধুনিক হওয়া নয়। বোরখা পরেও মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, এভারেস্টে উঠতে পারে।
৫। মেয়েটির নাম ঝর্ণা আক্তার। খেলোয়াড় ছিল, দৌড়, লং জাম্প ইত্যাদি খেলতো। তার ছোট ভাই জাতীয় ফুটবল দলে খেলে। ছোট ভাইকে খেলা ছাড়তে হয়নি, কিন্তু মেয়েটিকে মেয়ে বলেই খেলা ছাড়তে হয়েছে। এই খেলোয়াড় মেয়েটিকে এখন গৃহবধূর জীবন বরণ করতে হয়েছে। অনেকে বলছে মেয়েটি ক্রিকেট খেলছে না, মেয়েটি ক্রিকেট খেলছে না, সে তার ছেলেকে সঙ্গ দিচ্ছে। নিজের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তার পুত্রের সাধ আহ্লদ পূরণ করছে। আদর্শ মা হিসেবে মেয়েরা এভাবেই বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য খেলোয়াড় তাঁর খেলা ছেড়ে দেবেন, শিল্পী গান ছেড়ে দেবেন, চিত্রকর ছবি আঁকা ছাড়বেন, পেশাজীবী পেশা ছাড়বেন, শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছাড়বেন, ডাক্তার হাসপাতাল ছাড়বেন, নাট্যকর্মী মঞ্চ ছাড়বেন…তবেইনা নারী ‘ভালো মা’ ‘ভালো মেয়েমানুষ’ হয়ে উঠবেন! নারীর নিজের কোন জগৎ থাকবে না, যোগ্যতা থাকবে না, পরিচয় থাকবে না, সক্ষমতা থাকবে না, দক্ষতা থাকবে না, নারী কেবল সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন, স্বামীর সেবা করবেন, সবাইকে সুখে শান্তিতে রাখবেন, তবেইনা নারীর সার্থকতা!! ‘মাতৃত্বেই নারীর সার্থকতা’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’।
৬। হিজাব বোরখা নিকাব আবায়া খিমার কোনওটাই মেয়েদের ‘চয়েজ’ নয়, ঠিক যেমন পতিতাবৃত্তি মেয়েদের ‘চয়েজ’ নয়। এসবই আদিকাল থেকে মেয়েদের জন্য পুরুষের ‘চয়েজ’। পুরুষের চয়েজের চাপাতির তলায় মেয়েদের ইচ্ছেরা বলি হয়। মেয়েরা ভুল করে মনে করে এ বুঝি তাদের ইচ্ছে, তাদের ‘চয়েজ’। পুরুষেরা কেন পুরুষদের জন্য বোরখা নিকাব খিমার আবায়া ‘চয়েজ’ করে না? কেন পতিতাবৃত্তি তাদের ‘চয়েজ’ নয়? কারণ তারা জানে যে এসব মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার সব নষ্ট করে দেয়, মানুষকে কারাগারে বন্দী করে।
৭। ছবি দেখে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানের ছবি। তাহলে কি বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে?
৮। একজন মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে ক্রিকেট খেলছে, এটা প্রগতির লক্ষণ।
একজন অবরোধবাসিনী মা স্টেডিয়ামে এসে সন্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন, এটা সমাজ অগ্রগতির লক্ষণ।
৯। কোনো নারীই নিজের ইচ্ছেয় পছন্দ করে বোরখা পরে না। নারীকে নির্দেশ দেওয়া আছে যে তুমি তোমাকে আবৃত করে রাখবে। তুমি হচ্ছো সুস্বাদু রসগোল্লার মতো, পুরুষের খাওয়ার জিনিস। তোমাকে দেখলে চোখের জেনা। তুমি নিজেকে অনাবৃত রেখে সেই জেনায় অংশ নিচ্ছ, সেই জন্যে তুমি জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল জ্বলবে ইত্যাদি। এটা হচ্ছে তার বিশ্বাসের নির্দেশ। সাথে আছে সামাজিক এবং পারিবারিক চাপ। পর্দা কর, হিজাব পর, বোরকা পর, তাহলে লোকে তোমাকে ভালো বলবে, নাহলে মন্দ বলবে।
১০। ছোটবেলা থেকে যাকে নরকের ভয় দেখানো হয়েছে, আগুনে জ্বালাবার আর অনন্তকাল শাস্তি দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ছোটবেলা থেকেই তাকে এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, সে স্বাভাবিকভাবেই বোরখাই পরবে। সামাজিক এই ধারণা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং তাকে বোঝানো হয়েছে, বোরখা সে নিজেই পছন্দ করে বেছে নিয়েছে। সে ভেবেছে সে নিজেই ইচ্ছে করে বোরখা পরেছে, অথচ তার এই ইচ্ছেটি খুব সুকৌশলে তাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। তার এই ইচ্ছে স্বাধীনভাবে নেওয়া কোন পছন্দ নয়। ভীতির মাধ্যমে আদায় করে নেওয়া সম্মতি। যার পেছনে কাজ করেছে অন্ততকালের শাস্তির ভয়, সামাজিকভাবে হেয় করার আর ধর্ষণের পরোক্ষ হুমকি। বোরখা পরে ক্রিকেট খেলা ঐ নারী একটি শেকল ভাঙতে পেরেছে। এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। অন্য শেকলগুলো সে ভাঙতে পারুক না পারুক, সে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক অন্য নারীদের। পাখিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখলে সে খাঁচার ভিতরেই উড়তে চাইবে। এমনকি ডানা কেটে ফেললেও সে উড়তে চাইবেই।
১১। বোরকা না শর্টস, আফগান না বাংলা, চয়েস না ফোর্সড এসব আলাপে আমাদের ব্যস্ত রেখে মিড়িয়া কিন্তু এক দারুণ দাবার চালে আপসে দু’দুটো কিস্তিমাত করে ফেলেছে তুমুল হৈচৈ করে। ঝর্ণা আক্তারের মুখে দুটো পুরোনো অথচ ভয়ঙ্কর শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক স্টেটমেন্টকে নতুন করে বেশ পোক্ত করে দিয়েছে। “…আমার অ্যাথলেট জীবন আমি পিছে ফেলে এসেছি, সামনের নিজের জন্য কিছু চাই না। কেবল চাই আমার ছেলেটাকে বিকেএসপি পর্যন্ত পৌঁছে যেন দিতে পারি। ”
১২। মা যখন সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করান, তখন তাতে আমরা মা সন্তানের ভালোবাসা বা ভালোবাসায় পূর্ণ কাটানো সময় খুঁজে পাই না। তখন আমরা তাতে কেবল খুঁজে পাই নগ্নতা আর অশ্লীলতা। মা যখন খিমার পরে ক্রিকেট খেলে তখন আমরা ওখানে মাতৃত্বের বন্ধন আর অতি সুন্দর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সময়ের উপস্থাপন দেখতে পাই।
১৩। অনেকে মনে করে বোরখা পরা বা পর্দা করা মানে সে হয়তো বাইরে গিয়ে অন্যদের মতো লেখাপড়া, খেলাধুলা, চাকরি, ব্যবসা এসব স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না, যা সম্পূর্ণ ভুল। বোরখা পরেও ক্রিকেট খেলা যায় এই সচেতনতা বাংলাদেশের মতো একটি ৯৯% ইসলামিক দেশে অত্যধিক জরুরি। পর্দার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আমাদের ক্রিকেটার ভাইয়েরা তাদের পরবর্তী একটা সিরিজে দলীয়ভাবে বোরখা পরিধান করে মাঠে নেমে খেলে সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারে আসলে বোরখা পরেও ক্রিকেট খেলা সম্ভব, তাহলে হয়তো আরও অনেক বোন পর্দার ব্যাপারে উৎসাহী হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পর্দার ভিতরেই নারী সব করতে পারে কেননা ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সুবিধা। আমিন।
১৪। পোশাককে ওভারলুক করে সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহটাকেই বড় করে দেখা উচিত।
১৫। দাসত্বকে বরণ করে বিপ্লবের ডাক দেওয়া যায় না, সন্তানের মুক্তির আগে নিজের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত।
আলোচনা অনেক সময় ঝর্ণা আক্তারের বোরখা পরে ছেলের সংগে ক্রিকেট খেলার বাইরে চলে গিয়ে বোরখা নিয়ে এবং মিডিয়ায় একে হাইলাইট করার উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছে। যা কিছু নিয়ে হোক, এই যে বিতর্ক চলছে, এটি খুব দরকারি। যে কোনও বিতর্ককেই স্বাগত জানানো উচিত। সুস্থ সমাজেই বিতর্ক হয়। বিতর্ক হলেই মানুষ নানা মত সম্পর্কে জানতে পারে এবং নিজের অবস্থানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে সমাজে বিতর্কের জায়গা নেই, সেই সমাজ ভয়ংকর। বাংলাদেশ এখনও আফগানিস্তান হয়ে যায়নি, এখনও এ দেশ পিছিয়ে থাকা আরব দেশগুলোর মতো নয়। হিজাব বোরখা খিমার নিকাব আবায়া ইত্যাদি যদি বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা, তাহলে মেয়েদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি ব্যবসা খেলাধুলা কোনও কিছুতেই যেন পর্দা কোনও বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এখনও ইরান হয়ে যায়নি। পর্দা করা বাধ্যতামূলক নয়। পর্দা না করারও অধিকার এখন অবধি বাংলাদেশে আছে। আমি অবাক হবো না যদি একসময় ইরান এবং সৌদি আরবের মতো পর্দা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। গত তিন দশকে বাংলাদেশে মসজিদ মাদ্রাসা, নামাজ রোজা, পর্দা পুশিদা বেড়েছে। এসব বাড়ার কারণে নৈতিকতা বেড়েছে তা কিন্তু নয়। বাইরের আবরণ বদলে গেছে তা ঠিক। প্রদর্শন বেড়েছে। নীতিবোধ আগে যা ছিল, তা-ই আছে অথবা কমেছে। নৈতিকতা কিছু কম ছিল না বাংলাদেশে। সাত এবং আটের দশকে আমি ইস্কুল কলেজে পড়েছি। ইস্কুল কলেজের মেয়েরা তখন হিজাব বোরখা পরতো না, নামাজ রোজাও খুব একটা করতো না, কিন্তু নীতিবোধ সবারই ছিল, ভালো মন্দের জ্ঞান ছিল। মন্দটাকে এড়িয়ে চলতো, ভালোটাকে গ্রহণ করতো। সাত/আটের দশকে পুরুষের কপালে, দাড়ি গোঁফে, পোশাক আশাকে ধর্মের ছোঁয়া এখনকার মতো লাগেনি। কিন্তু মানুষ হিসেবে অধিকাংশই মন্দ ছিল না। প্রচুর আদর্শবাদীর দেখা মিলতো। চোর ডাকাত খুনি ধর্ষক মিথ্যুক জালিয়াত আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে আগে তাদের শরীরে এত বেশি ধর্মীয় পোশাক ছিল না, এখন আছে। ধর্মীয় পোশাক আগে মানুষ লোভ লালসা বিসর্জন দিয়েই গায়ে চড়াতো। এখন জিরো নৈতিকতা নিয়েই গায়ে চড়ায়। এতে ধর্মীয় পোশাক পরা মানুষের ওপর থেকে অনেকের বিশ্বাস সরে যাচ্ছে। এ ভালো লক্ষণ নয়।
লেখক : নির্বাসিত তসলিমা নাসরিন