ভয়াবহ বন্যা ও মানবিকতা

প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০২০

রণজিৎ মোদক : নদীমাতৃক বাংলাদেশে ঝড়-জলোচ্ছ¡াস বন্যার সাথে অনেক দিনের পরিচয়। মাটি আর মানুষের মন একই সূত্রে গাঁথা। সংকটে-সংগ্রামে অকুতোভয় বাঙালি। সত্তরের জলোচ্ছাস, ৮৮-৯৮ দীর্ঘায়িত ভয়াবহ বন্যা আমাদের ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে কিন্তু বুকের পাঁজর ভাঙতে পারেনি। সাহস নিয়ে ভাঙ্গা ভিটিতে আবার নতুন করে ঘর বেধেছে মানুষ।

বর্তমানে উত্তরের আচমকা জল¯্রােতে বাংলাদেশের ১৮টি জেলা বন্যা প্লাবিত। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি গৃহহারা আশ্রয়হীন পরিবেশে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। বন্যা বিশেষজ্ঞদের মতে এবারের বন্যা ৮৮ বন্যার চেয়েও ভয়াবহ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একে তো ঘাতকব্যাধি করোনা তার উপর ভয়াবহ বন্যা। ‘এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। ৮৮ এবং ৯৮’র বন্যায় মানুষের মধ্যে মানুষের জন্য একটা আন্তরিক অনুভ‚তি কাজ করেছে। একে অপরের কষ্টকে ভাগ করে নিয়েছে। ৮৮’র বন্যায় ডিএনডিবাসীকে রক্ষার জন্য তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফেজ মোক্তার স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় তরুণদের নিয়ে রাতদিন প্রচেষ্টায় বন্যার্তদের রক্ষা করেন। সে দৃশ্য চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। তবে যা বলছি তা সত্য। প্রত্যক্ষদর্শীরা এখনো অনেকেই রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ শহর ও তার পার্শ্ববর্তী বন্যা প্লাবিত এলাকার ভিডিওচিত্র ধারণ করে মার্ক ভিডিও সেন্টার কর্তৃপক্ষ এস.এ শামীমের নেতৃত্বে আমরা ফ্রান্স, ইতালি, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বাঙ্গালীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা এসেছে। তাছাড়া স্থানীয় ধর্নাঢ্য শিল্পপতি পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আফাজুল ইসলাম, পঞ্চবটির ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ তাছাড়া ব্যবসায়ী মোঃ শাহজাহান, সরকারি কর্মকর্তা মীর মোজাম্মেল আলী ও দেলোয়ার প্রধানসহ অনেকেই এক একদিন এক এক এলাকায় শুকনো খাবার চিড়া-গুড় এমনকি রান্না করা খাবার বিতরণ করেন।

১৯৯৮ এর ভয়াবহ বন্যাও এক দীর্ঘস্থায়ী বন্যা রূপে দেখা দেয়। ভয়াবহ বন্যার চিত্র দেখে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যৎ মন্তব্য করেন- ‘এদেশের লক্ষাধিক লোক না খেয়ে মারা যাবে।’ সে সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘এদেশের একটি মানুষও না খেয়ে মারা যাবে না।’ বন্যায় সত্যিই কেউ না খেয়ে মারা যায়নি। নারায়ণগঞ্জ শহরে কোমর পানি ভেঙে টিএনটি অফিসের রুমে গিয়ে হাবিবুর রহমান, বংশী সাহা, বাদল, নাহিদ ভাই, অহিদুর রহমান, বিমল রায়, এআর কামাল ভাই, মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ ভাই সহ আমরা জেলার নিউজ স্ব স্ব পত্রিকায় পাঠাতাম। বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা বেঁজে যেত। সে সময় অনেক গৃহবধূরাও তাদের গৃহে আটার রুটি তৈরী করে দরিদ্র অসহায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করতে দেখেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও নেতাকর্মীবৃন্দ ত্রাণ বিতরণ করেছেন। শিল্পপতি মোহাম্মদ আলী বক্তাবলী দরিদ্র পরিবারদের মাঝে দশটি রিক্সা বিতরণ করেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার সবার মধ্যেই সেবা মনোবৃত্তি লক্ষ করা গেছে। একসময়ের ডিএনডি বাঁধের ভেতর বৃষ্টিতে অথৈ পানি জমে কয়েক হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। সে সময় ফতুল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিল্পপতি শাহআলম দীর্ঘদিন তাদের তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ গেলো চোখে দেখা বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগের কথা।

ভয়াবহ বন্যা দুর্যোগের কারণগুলো অবশ্যই বিজ্ঞজনরা বলতে পারেন। বাংলাদেশের উজানে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ এর প্রধান কারণ। নদীসমূহের নাব্যতা হ্রাস। তাছাড়া স্থানে স্থানে বাঁধ ও সড়কপথ নির্মাণের কারণে বৃষ্টি ও বর্ষার পানির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় বর্ষা বন্যার রূপ নিচ্ছে। এবার ২০২০ সালের বন্যাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা পূর্বেই সমস্ত বিভাগকে তাদের দায়-দায়িত্ব পালনে নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তারপর ভয় করোনায় সরকার যথেষ্ট ত্রাণ দিচ্ছেন। কিন্তু সেইসব ত্রাণগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার লক্ষ্যে অনেকে ত্রাণ আত্মসাৎ করছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তা প্রকাশ পাচ্ছে। এই ভয়াবহ বন্যায় সরকার তৎপর রয়েছেন। কিন্তু মানুষের মানবিক গুণগুলো ভোতা হয়ে গেছে। পূর্বের ন্যায় ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই গানটি এখন আর কারো প্রানে তেমন বাজে না। দিনদিন মানবতার অবক্ষয় হচ্ছে। মানুষ স্বার্থান্বেষী হয়ে উঠছে। তারপরও ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই গান গেয়ে যাব চিরদিন।

আপনার মতামত লিখুন :